গত শতাব্দীতেও গ্রামের মানুষ তার চারপাশের পুষ্প, বৃক্ষ, লতা, গুল্মের খোঁজখবর রাখত। হেন গাছ ছিল না, যা চিনত না, উপকারিতা সম্পর্কে জানত না। যান্ত্রিক সভ্যতা এখন গ্রামেও পৌঁছে গেছে, পৌঁছে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে বৃক্ষের প্রতি মানুষের প্রেম। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ এখন বৃক্ষকে শুধু অর্থকরী সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে। গাছ বিক্রি করে টাকা আয় করাই তাদের লক্ষ্য। অর্থ ছাড়াও বৃক্ষ যে মানুষের বহুমাত্রিক উপকারে আসে সেই কথাটা সবাই ভুলে যাচ্ছে।
মানুষকে এই প্রকৃতি-বিস্মরণ থেকে বাঁচাতে আমাদের প্রকৃতিবিদদের চেষ্টার অন্ত নেই। পত্রিকায় লিখে, টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করে, বই-পুস্তক রচনা করে তাঁরা মানুষকে বৃক্ষ সম্পর্কে সচেতন করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে দ্বিজেন শর্মার কথা আমরা অনেকেই জানি। একটা জীবন তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন বৃক্ষ নিয়ে, পুষ্প-লতা-গুল্মকে ভালোবেসে। তিনি এখন আমাদের মাঝে নেই। তাঁর মতো যেসব প্রকৃতি-অন্তপ্রাণ মানুষ প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের সচেতন করছেন, প্রকৃতিপ্রেমের দীক্ষা দিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে মোকারম হোসেন একজন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি প্রকৃতি নিয়ে কাজ করছেন।
সম্প্রতি তিনি একটি বড় কাজ করেছেন। ‘বাংলাদেশের পুষ্প-বৃক্ষ লতা-গুল্ম’ নামের একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। বইটি আসলে প্রায় ৬০০ প্রজাতির গাছপালার ফিল্ড গাইড। আমি প্রকৃতি নিয়ে কাজ করি না। আবার করিও। কিভাবে করি? আমি তো গল্প-উপন্যাস লিখি। গল্প-উপন্যাসে প্রকৃতিকে ফিউশন করতে হয়। আমার উপন্যাস কেন, কোনো ঔপন্যাসিকই প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে উপন্যাস লিখতে পারেন না। কোনো না কোনোভাবেই তাঁর উপন্যাসে অনুষঙ্গ হিসেবে প্রকৃতি আসবেই। সুতরাং গল্প-উপন্যাস লিখতে হলে প্রকৃতি সম্পর্কে, পুষ্প-লতা-গুল্ম সম্পর্কে জ্ঞান থাকা চাই। কিন্তু এই সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমিত। এ জন্য আমাকে সাহায্য নিতে হয় প্রকৃতিবিদদের রচিত বিভিন্ন বই-পুস্তকের। লিখতে বসলেই আমার টেবিলে শ্রদ্ধেয় দ্বিজেন শর্মার ‘শ্যামলী নিসর্গ’ ও ‘নিসর্গ কথা’ বই দুটি থাকবেই। এখন এ দুটি বইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মোকারম হোসেনের ‘বাংলাদেশের পুষ্প-বৃক্ষ লতা-গুল্ম’ বইটি। বাংলাদেশের হেন ফুল নেই, হেন বৃক্ষ নেই, হেন লতা-গুল্ম নেই, যার কথা লেখেননি মোকারম। শুধু লেখাই নয়, সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন প্রতিটি পুষ্প, বৃক্ষ, লতা, গুল্মের রঙিন ছবিও। আবার বিন্যাসটা করেছেন এমনভাবে, যেন একজন সাধারণ পাঠকও খুব সহজেই তাঁর কাঙ্ক্ষিত বৃক্ষটি খুঁজে নিতে পারেন। আমার কাজকে বইটা কত যে সহজ করে দিয়েছে, তা লিখে শেষ করার নয়। আমার মনে হয় প্রত্যেক লেখকের টেবিলে বইটি থাকা আবশ্যক।
শুধু লেখক কেন? পরিবেশবিদদের সচেতনার ফলে এখন শহুরে মানুষরাও বৃক্ষ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছে। শহরের বহুতল ভবনের বারান্দায়, ছাদে বা টবে এখন নানা প্রজাতির গাছ লাগানো হচ্ছে। টবে পুষ্প, বৃক্ষ, লতা, গুল্ম লাগানোটা শহুরে গৃহিণীদের শখের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এটা খুবই ইতিবাচক ব্যাপার। তাদের জন্যও মোকারম হোসেনের বইটি কাজে লাগবে। কোন গাছ টবে হয়, কোন গাছ হয় না, সেই সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে এই বই থেকে।
যেমন তিনি ‘বেলি’ ফুলের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘ব্যক্তিগত বাগানসহ বিভিন্ন পার্ক ও উদ্যানে আছে। ছোট ঝোপালো গাছ। কচি ডাল রোমশ, পাতা একক, ডিম্বাকার, গাঢ়-সবুজ। সাদা রঙের গুচ্ছবদ্ধ সুগন্ধি ফুলগুলো ফোটে গ্রীষ্ম ও বর্ষায়। সুগন্ধের জন্য সারা বিশ্বেই বেশ জনপ্রিয়। বংশবৃদ্ধি কলম ও শিকড় থেকে গজানো চারার মাধ্যমে করা হয়। শীতে ছেঁটে দিতে হয়। টবেও ভালো থাকে। ভারত, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পাওয়া যায়। বিপন্ন নয়।’
পুষ্প, বৃক্ষ, লতা, গুল্ম নিয়ে বৃহৎ পরিসরের অথচ সহজে বহনযোগ্য এমন শ্রম ও কষ্টসাধ্য কাজ বাংলাদেশে এর আগে আমার নজরে আসেনি। সরকারি উদ্যোগে এ ধরনের একটি কাজ হওয়ার দরকার ছিল। হয়নি। এই দেশে সরকারি উদ্যোগে এ ধরনের কাজ খুব বেশি হয় না। ব্যক্তি উদ্যোগেই হয়। মোকারম হোসেন কাজটি করে একটি জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। সরকারি উদ্যোগে বইটির প্রচার-প্রচারণা করা দরকার।
বাংলাদেশের পুষ্প-বৃক্ষ লতা-গুল্ম মোকারম হোসেন তরুপল্লব-আইইউসিএন, ঢাকা প্রচ্ছদ : নাজমুল আহসান সেপ্টেম্বর ২০১৭ মূল্য : ৯০০ টাকা।
No comments:
Post a Comment