Monday, September 9, 2019

বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট পাখি ফুলঝুড়ি

কিউবার পাখি হামিংবার্ড সারা পৃথিবার সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম পাখি। রঙ ঝলমলে অদ্ভুত সুন্দর এই পাখটির আকৃতি মাত্র ৪.৯ সেন্টিমিটার। পাখিটি এতো ক্ষুদ্র যে সহজেই একে হাতের মুঠোয় ভরে ফেলা যায়।

 আর বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট পাখি ফুলঝুরি। আমাদের ফুলঝুরিও বেশ রূপবতি পাখি। সুন্দর, মিষ্টি গানের গলা, সাহসী এবং কিছুটা লাজুক স্বভাবের এই পাখিটি আমাদের দেশে এখনো প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। রাজধানী ঢাকাতেও দেখা যায় ব্যাপকহারে। তবে পাখিটি আকারে অনেক ছোট হওয়ায় খুব একটা নজরে পড়ে না।

গাছের ডালে ডালে সারাক্ষণ চিক্ চিক্ শব্দে চঞ্চলভাবে উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায় ওরা। খুবই অস্থির স্বভাবের পাখি ফুলঝুরি। চুপ করে যেন বসতেই পারে না। ওড়ার সময় কিংবা গাছপালার ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ানোর সময় সে চিক্ চিক্ করে একটানা ডেকে যায়। মাঝে মাঝে ক্ষীণ স্বরে ওদের গান গাইতেও শোনা যায়। ওদের গানের গলা টুনটুনি বা দোয়েলের মতো অতো তীব্র না হলেও বেশ মিষ্টি।


 ফুলঝুরির ইংরেজি নাম TICKEU’S FLOWER PECKER। বৈজ্ঞানিক নাম Dicaeum emrythrorhynchos।

ফুলঝুরিকে প্রথমে দেখে টুনটুনি বলে ভুল হয়। কিন্তু আকৃতিতে এই পাখি টুনটুনির চেয়েও ছোট। আর ফুলঝুরির লেজ টুনটুনির মতো ওপরের দিকে উঁচু করা থাকে না। থাকে শরীরের সঙ্গে সমান্তরালভাবে নিচের দিকে নামানো।

ফুলঝুরির কপাল ডানা ও পিঠের ওপরের পালকের রঙ জলপাই বাদামি থেকে হালকা জলপাই। ডানার অগ্রভাগে অস্পষ্ট কালচে ভাব রয়েছে। বুকের দিকের রঙ ধূসর সাদা। চঞ্চু খাটো, পাতলা, খুব শক্ত এবং নিুমুখী। চঞ্চুর রঙ মাংসের রঙের মতো। কখনো কখনো হালকা হলুদ হতেও দেখা যায়। লেজ ছোট, নিচের দিকের তলের অংশ কালো।

ওদের শরীরের মাপ ৮ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ ফুলঝুরি দেখতে একই রকম।

 ওদের প্রিয় খাবার নানা রকম ফল ও ফুলের মধু। তবে বিভিন্ন রকম ক্ষুদ্র কিট-পতঙ্গও ওরা খেয়ে থাকে। গেরস্থের বাগানের ফল গাছে হামলা করতে ওস্তাদ এই ফুলঝুরি।
পাকা পেঁপে বা ওই জাতীয় ফল খেতে খেতে ছোট্ট শরীরসুদ্ধ ফলের ভেতর ঢুকে পড়ে ওরা। ফুলঝুরি খাওয়ার ব্যাপারে বেশ পেটুক।

 গ্রীস্মকাল ওদের প্রজননে সময়। এ সময় বেশ উঁচুতে গাছের ডালে ছোট থলির মতো ঝুলন্ত বাসা বানায়। বাসার স্থান নির্বাচন সাহেব-বিবি মিলে করলেও বাসা তৈরি করা ও ডিমে তা দেয়ার দায়িত্ব বিবির একাই। তবে বাচ্চাদেরকে দুজনে মিলেমিশেই খাওয়ায়। ওদের ডিমের সংখ্যা ২টি এবং রঙ একদম সাদা।


আমাদের দেশে ফুলঝুরিকে বেশ কয়েকটি নামে ডাকা হয়। কেউ কেউ ওকে ফুলচুষি বলে। আবার কোনো কোনো অঞ্চলে ওকে মধুচুষিও বলা হয়।

 বাংলাদেশে একটি পরিযায়ীসহ ৭ প্রজাতির ফুলঝুরি সনাক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে ফুলঝুরির ৭টি প্রজাতির মধ্যে মেটেঠোঁট ফুলঝুরি ও লালপিঠ ফুলঝুরি (Scarlet-backed Flower pecker) দেশের সব এলাকায় দেখা যায়।

এছাড়াও অন্য এক প্রজাতির ফুলঝুড়ি আমাদের প্রকৃতিতে ঘুরে বেড়ায়। ওর নাম আগুনবুক ফুলঝুরি। এই প্রজাতিটি দেখা খুবই দুষ্কর।

বিশ্বের ক্ষুদ্রতম পাখির নাম ‘বি হামিংবার্ড’, যা লম্বায় মাত্র ৪ দশমিক ৯ সেন্টিমিটার এবং ওজনে ১ দশমিক ৭৫ গ্রাম হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষুদ্রতম পাখিটির খোঁজ কজনই বা রাখেন? সংখ্যায় যথেষ্ট থাকলেও অত্যন্ত লাজুক ও সাবধানী হওয়ায় সহজে নজরে আসে না। 

ছোট্ট এ পাখিটির নাম মেটেঠোঁট ফুলঝুরি (Pale-billed Flowerpecker)। লম্বায় মাত্র আট সেন্টিমিটার এবং ওজনে ৬ দশমিক ৩ গ্রাম। প্রজাতিভেদে হামিংবার্ড পাঁচ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা হলেও ফুলঝুরিগুলো হয় আট থেকে ১৩ সেন্টিমিটার। এরা ফুলচুষি বা ফুলচুষকি নামেও পরিচিত।

এ দেশে ফুলঝুরির আটটি প্রজাতির মধ্যে মেটেঠোঁট ফুলঝুরি ও লালপিঠ ফুলঝুরি (Scarlet-backed Flowerpecker) প্রজাতি দুটিই বেশি চোখে পড়ে। বাকি প্রজাতি দুষ্প্রাপ্য। দুটি প্রজাতিই প্রায় সমান সংখ্যায় আছে এ দেশে। মেটেঠোঁট ফুলঝুরি গ্রাম-বন-শহর-সবখানেই দেখা যায়।


ছোট ছোট ফলের বীজ খেয়ে এরা পরাগায়ণ করে গাছের বংশবিস্তারেও সাহায্য করে।

মেটেঠোঁট ফুলঝুরি দেখতে মোটামুটি সুন্দর; বৈজ্ঞানিক নাম Dicaeum erythrorynchos। পিঠের রং ধূসর-জলপাই, যা মাথা ও পাখার কাছে কিছুটা গাঢ় হয়। দেহের নিচের দিকের রং হালকা জলপাই, যা গলার দিকে কিছুটা ময়লা হলদেটে। পেট ফিকে বাদামি। লেজ খাটো, ঠোঁট ছোট। ঠোঁটের রং কাঁচা মাংসের মতো। স্ত্রী-পুরুষ ফুলঝুরি দেখতে একই রকম। ছোট্ট এই পাখিগুলো চমৎকার ভঙ্গিমায় ওড়ে। বন ও বাগানের ওপর দিয়ে উড়তে পছন্দ করে। মিষ্টি স্বরে গান গায়। তবে গলার স্বর খুব জোরালো নয়। এরা খুবই লাজুক ও ভিতু। আবার কিছুটা চতুরও বটে। খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টকর। ডালপালার আড়ালে ঘুরে বেড়ায়। লুকিয়ে গান গায়। কিন্তু গান শুনেও খুঁজে বের করা কষ্টকর। জনসমক্ষে আসে না। এমন কোনো শব্দ করে না, যাতে মানুষের কাছে ধরা পড়ে যায়। এরা অন্যান্য ছোট পাখি, যেমন: মৌটুসি, নীলটুনি বা হামিংবার্ডের মতো আকাশে স্থির থেকে উড়তে পারে না; তবে চেষ্টা করে। তা ছাড়া হামিংবার্ডের মতো পেছন দিকেও উড়তে পারে না। মেটেঠোঁট ফুলঝুরির প্রধান খাবার পাকা ফল। যেমন: সফেদা, আতা, কলা, পেঁপে, পেয়ারা এমনকি বেল। খায় হাভাতের মতো। ফল খেতে খেতে ফলের ভেতর ঢুকে যায়। বাইরে থেকে বোঝা যায় না যে ভেতরে বসে ফল খাচ্ছে। অথচ ফলটি নড়ছে। হঠাৎ দেখলে ভূতুড়ে কাণ্ডই মনে হবে। ফলের ভেতর ঢুকে অদৃশ্য হয়ে ফল খাওয়া এমন পাখি এ দেশে আর দ্বিতীয়টি নেই। এদের ঠোঁটের এমন কোনো সামর্থ্য নেই যে সামান্য আধা পাকা ফলও ছিদ্র করে। কিন্তু অন্যের ছিদ্র করা ফলে দখল নেওয়ার যোগ্যতা আছে ভালোই। ছোট ছোট ফলের ওপরে বসে বা ঝুলে যখন ওরা খায়, তখন দেখলে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। খোসা ছাড়িয়ে পাকা লিচু খায় শৈল্পিক ভঙ্গিতে। এরা অনেক সময় মধুও পান করে।


মেটেঠোঁট ফুলঝুরি সাধারণত দুটো ডিম পাড়ে। ডিমের রং ঘোলাটে সাদা। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে ১৩-১৫ দিনে। ফোটার পর মা-বাবা দুটিই বাচ্চাদের খাওয়ায় ও যত্ন নেয়। বাচ্চারা উড়তে শেখে ১৩-১৪ দিনে। প্রায় ২২-২৪ দিন বয়সে ছোট্ট লাজুক পাখিগুলো বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়।

লালচে ফুলঝুরিগুলো ফুলের মধুই বেশি পছন্দ করে; তা ছাড়া কীটপতঙ্গ, মাকড়সা, ফল ইত্যাদিও খায়। বছরে তিনবার বাচ্চা দেয়। বাসা হয় খুব ছোট। সাধারণত মাটি থেকে পাঁচ থেকে ১০ মিটার উঁচুতে কোনো একটি গাছের সরু ডালে বাসা বাঁধে। তবে খুব গোপনে, যেন কেউ না দেখে। সাধারণত স্ত্রী পাখি তিন-পাঁচ দিনে বাসা বানায়। বাসা দেখতে অনেকটা রাজহাঁসের ডিমের আকারের হয়। নরম তন্তু দিয়ে খুব মসৃণ করে বাসা বানায়। বাসা পরিচ্ছন্ন ও গোছানো থাকে সব সময়। ঝুলন্ত বাসা দেখতে কিছুটা মৌটুসির বাসার মতো। তবে মৌটুসির মতো এরা বাসার দরজার ওপর কোনো কার্নিশ বানায় না।





https://www.youtube.com/watch?v=WTLaDheQb2s

https://www.youtube.com/watch?v=7Ik6M7Pb-dA

https://www.youtube.com/watch?v=x33RgUIsG20

https://www.youtube.com/watch?v=WcNJPAeHvtQ


No comments:

Post a Comment