ল্যান্ডস্কেপ হচ্ছে প্রাকৃতিক ভূ-দৃশ্য বা প্রাকৃতিক দৃশ্য অঙ্কনের
চিত্রকলা। ল্যান্ডস্কেপিংয়ের মাধ্যমে একটি অঞ্চল, দেশ বা পুরো জগেকই
বিরামহীন সৌন্দর্যে পরিণত করা যায়। উন্নত দেশগুলোতে ল্যান্ডস্কেপিংকে
গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হলেও বাংলাদেশে এর ব্যবহার খুব সীমিত। নগর
উন্নয়ন, পরিবেশ উন্নয়ন ও নগরকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করতে প্রয়োজন সুশৃঙ্খল
নান্দনিক পরিকল্পনা।
শহরের ক্লান্তি এবং একঘেঁয়েমি দূর করতে
ল্যান্ডস্কেপ সফলভাবে কাজ করে। তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। ফুল, বৃক্ষরাজি,
নুড়ি-পাথর, ঝর্ণা, কৃত্রিম লেক এবং অব্যবহূত সামগ্রী (ফেলে দেওয়া) ইত্যাদি
উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে একটি সুন্দর ল্যান্ডস্কেপে রূপ দেওয়া সম্ভব।
আকৃতি ও পরিধি অনুযায়ী ল্যান্ডস্কেপ ভিন্নভাবে নির্মাণ করা হয়।
কলেজ-ক্যাম্পাস, পার্ক, বিনোদনের জন্য ক্ষুদ্রাঞ্চল, শিল্প-কারখানা,
অট্টালিকার সম্মুখভাগ, শহরের আইল্যান্ড, রাস্তার দু’পাড়, ত্রিকোনা স্থান,
লেকের পাড়- একেক স্থানের ল্যান্ডস্কেপ একেক রকম হয়। আবার কোনো ডিজাইন
পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমেও এর মনোমুগ্ধকর রূপ দেওয়া সম্ভব। পেশাদারি দক্ষতা,
অভিজ্ঞতা, বনরক্ষণবিদ্যা, সৌন্দর্য বিষয়ক অভিজ্ঞতা, স্থাপত্য, বাগান
পরিচর্যার দক্ষতা, ভূ-তত্ত্ব বিষয়ক অভিজ্ঞতা থাকলে অনায়াসেই একটি
বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত ল্যান্ডস্কেপ সৃষ্টি করা সম্ভব। রাজধানীতে
ল্যান্ডস্কেপ নির্মাণের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রক্ষণাবেক্ষণ।
সুশৃঙ্খল ও সুপরিকল্পিতভাবে হয়তো বিভিন্ন স্থানের ডিজাইন করা সম্ভব কিন্তু
পরবর্তী সময়ে সেগুলোর যথাযথ দেখভাল বা নিয়মিত পরিচর্যা না করলে সৌন্দর্য
অটুট বা টেকসই থাকে না।জনগণের মধ্যে সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত করে তাদেরকেও এর
সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। আমাদের প্রিয় নগরী ঢাকা বার বার বসবাসের অযোগ্য
শহর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ থেকে রেহাই পেতে ল্যান্ডস্কেপ নির্মাণ কার্যকর
ভূমিকা রাখতে পারে। সেজন্য নগরের পরিচ্ছন্নতার বিষয়টির পাশাপাশি বেশি করে
সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হবে। গণমাধ্যম এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা
রাখতে পারে।
সবুজ গাছ শহরে যেটুকু আছে, সেগুলো
রক্ষণাবেক্ষেণ করতে হবে। পরিকল্পনামাফিক গাছপালা, পুষ্পরাজি রোপণ করতে হবে।
এক্ষেত্রে পরিবেশবাদীদের ব্যাপক ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। শব্দ এবং বায়ু
দূষণের নগরীতে ল্যান্ডস্কেপের লতাগুল্ম ও গাছপালা শান্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও
নির্মল বায়ুর যোগান দেয়। চোখকে করে প্রশান্ত। শুধু তাই নয়, ল্যান্ডস্কেপের
ফলে উষ্ণ শহরে উত্তাপ কমে। ধুলোবালি কমে, সৃষ্টি হয় স্বাস্থ্যকর পরিচ্ছন্ন
পরিবেশ।
বাঙালি বছরব্যাপী উত্সব-পার্বণে মেতে থাকে। কোনো
উত্সব এলেই বহুজাতিক সংস্থা প্রচার ও প্রসারের জন্য গাছকে কাপড় পেঁচিয়ে
সৌন্দর্যবর্ধন করতে চেষ্টা করে। এগুলো সৌন্দর্যের পরিপন্থি। ল্যান্ডস্কেপের
ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মানতে হবে যেমন ব্রিটিশ আমল থেকে সরকারি সংস্কৃতি গাছে
রং করা এ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। গাছে রং করা, গাছে পেরেক মেরে বিজ্ঞাপন
প্রচার বন্ধ করতে হবে। টবে রং করা যাবে না। ফুটপাতে বিদ্যমান গাছের গোড়া
কংক্রিট দিয়ে আটকানো যাবে না। সড়কের মিডিয়ানে বড় গাছ না লাগিয়ে তুলনামূলক
ছোট আকৃতি ও কষ্টসহিষ্ণু গাছ লাগাতে হবে। বাড়ি বা পাঁচিলের দেয়ালে ক্লিপার
গাছ ওঠাতে হবে। তাহলে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে এবং খরচও সাশ্রয়ী হবে।
রাস্তা বা খোলা স্থানেই নয়, ল্যান্ডস্কেপের মাধ্যমে বাসা-বাড়ির সম্মুখ
স্থান সৌন্দর্যও বাড়িয়ে তোলা যায় বহুগুণ। ময়লা-অবর্জনা পরিষ্কার তো থাকে।
বাড়ির সামনে ক্ষুদ্র জলাশয় থাকলে হাঁস-মাছ চাষ করলে পানি নড়াচড়া হয়, ফলে
সেই জমানো পানিতে ডেঙ্গু মশার বংশ বিস্তার ঘটে না। ল্যান্ডস্কেপের কারণে
ভিন্নতর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ ধরনের পরিবেশ খুব সহজেই পরিবেশের ভারসাম্যের
জন্য সহায়ক। ল্যান্ডস্কেপের প্রয়োজনীয় উপকরণের ফলে, চারপাশে মৌমাছি, পাখি,
ফড়িং, প্রজাপতি বিভিন্ন পতঙ্গ ও ক্ষুদ্র প্রাণীর আগমন ঘটে। ওখানে তাদের
আবাস, খাদ্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
স্থাপত্যের ক্ষেত্রে
ল্যান্ডস্কেপের গুরুত্ব অপরিসীম, এক্ষেত্রে ল্যান্ডস্কেপকে শিল্পকলা হিসেবে
গণ্য করা হয়। দুটি বিষয়ের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। স্থাপত্য এবং
ল্যান্ডস্কেপ একে অন্যের পরিপূরক এবং সম্পূর্ণ স্থায়ী সৌন্দর্যের রূপ পেতে
সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মানুষের ভেতরের সৌন্দর্যকে জাগ্রত করার পাশাপাশি
নগরেও সবুজ-শ্যামল বাংলার অপার সৌন্দর্যের রূপ উপস্থাপন করা সম্ভব
ল্যান্ডস্কেপ নির্মাণের মাধ্যমে। একমাত্র ল্যান্ডস্কেপ শিল্পকর্ম নির্মাণই
পারে সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সবুজ নগর উপহার দিতে
কারণ পরিচ্ছন্নতা এবং সবুজায়নই ল্যান্ডস্কেপের মূল কাজ। ল্যান্ডস্কেপের
কাজটি সফল হলেই সৃষ্টি হবে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। এই নগরীও আমাদের কাছে আরো
প্রিয় হয়ে উঠবে। বাড়বে পর্যটকের আনাগোনা। বাড়বে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার
রিজার্ভ।
ইদানীং দেখা যাচ্ছে বিলবোর্ডের বিকল্প হিসেবে বড়
বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ল্যান্ডস্কেপকে বেছে নিচ্ছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক,
দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। অপরিকল্পিত বিলবোর্ড, ফেস্টুন, ব্যানার শহরের
সৌন্দর্য নষ্ট করে। অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো
স্পন্সরের মাধ্যমে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ লোকেশনের ল্যান্ডস্কেপ করলে
নাগরিকগণ উক্ত স্থানে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। এতে করে সাধারণ মানুষের
কাছে পৌঁছানো আরো সহজ হয়। রাজনৈতিক নেতারাও বিলবোর্ডের প্রতি আগ্রহী
হচ্ছেন। আমি বলবো, নগরকে নিঃসর্গে পরিণত করুন। মানুষকে সতেজ নিঃশ্বাস ফেলার
সুযোগ করে দিন। নিজের নামে ল্যান্ডস্কেপ নির্মাণ করুন নগরবাসী আপনাকে মনে
রাখবে।
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষের রুচিবোধও পরিবর্তন হচ্ছে।
যাপিত জীবনধারা ও শহর, নগর পরিকল্পনামাফিক বিনির্মাণ হলে আমরা বাংলাদেশের
আবহমান প্রকৃতি ও নান্দনিক শহরে বসবাস করতে পারব। বহির্বিশ্বের কাছে
বাংলাদেশের অবস্থান ভৌগোলিক গুরুত্বের পাশাপাশি ‘প্রকৃতির দেশ বাংলাদেশকে’
তুলে ধরতে সক্ষম হবো।
No comments:
Post a Comment