Sunday, September 15, 2019

বহুতলের ভারে সবুজ বিলীনপ্রায়



মহানগর ঢাকার কংক্রিট আর বহুতলের ভারে সবুজ বিলীনপ্রায়। এর মাঝে হঠাৎ মনে হয় খানিক অরণ্যের আভা। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের গাছ-প্রকৃতি ছড়িয়েছে নগরে অরণ্যের উৎসব।

সকাল সকাল জেগে ওঠা, মৃদুমন্দ বাতাস, বিকেলের নরম রোদে ছাদ-বাগানে সময় কাটানো বা রাতে তারাভরা আকাশ দেখা

ঢাকা শহরের অনেক নাগরিকের জন্য স্বপ্নই বটে। ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত এবং পরিবেশবান্ধব ফ্ল্যাটকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ক্রেতারা।

বাড়ির পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত করতেও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও নকশার ক্ষেত্রে সেটব্যাকের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করেছে। সেটব্যাক মেনে ভবনের নকশা করলে সামনে-পেছনে জমির আয়তন অনুসারে জায়গা ছাড়তে হয়, ফলে ভবন নির্মাণের পর আলো-বাতাসের পর্যাপ্ত উৎস রাখা সম্ভব হয়।

যেসব ভবনে দিনের আলোতেও বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করতে হয়, সেখানে বিদ্যুৎ-খরচও বেশি হয়।

ভবনের পরিবেশ কতটা স্বাস্থ্যসম্মত সে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েই তারা ফ্ল্যাট কেনা উচিত ।

সাধারণভাবে অনেক ক্ষেত্রেই মনে করা হয় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্রেতারা ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব বিষয়টিকে ততটা গুরুত্ব দেন না। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ক্রেতাদের মধ্যে পরিবেশবান্ধব আবাসনের ব্যাপারে গুরুত্ব অনেক বেড়েছে।

বহুজাতিক প্রোপার্টি পোর্টাল লামুডি ডটকম পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্রমবর্ধমান পরিবেশবান্ধব ও যুগোপযোগী আবাসন চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে গত ছয় মাসে বাংলাদেশে লামুডির ওয়েবসাইটে পরিবেশবান্ধব ঘরবাড়ি ও বাণিজ্যিক-ভবনগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪২০ শতাংশেরও অধিক। লামুডির গ্লোবাল কো-ফাউন্ডার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পল ফিলিপ হারম্যান বলেন, ‘আমাদের মাঝে অনেকেই মনে করেন উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ঘরবাড়ি খোঁজ করার ক্ষেত্রে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। নতুন এই গবেষণা-প্রতিবেদন আমাদের এই ধারণা ভুল প্রমাণিত করেছে।


এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকায় পরিবেশমুখী সবুজ আবাসন দ্রুততার সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা প্রমাণ করে এই দুই অঞ্চলের দেশগুলোর ক্রেতাদের মধ্যে পরিবেশ-বিষয়ক সচেতনতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা এখন শুধুই সময়ের ব্যাপার যে, দ্রুত উন্নয়নশীল এই দেশগুলোতে খুব শিগগিরই সবুজ আবাসনের জোগান ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।’
বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোও পরিবেশবান্ধব আবাসনের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকারিভাবে সব ভবনের আলোর শতকরা ৩ শতাংশ বিকল্প উৎস হিসেবে সোলার থেকে ব্যবস্থা করার অনুরোধ করা হয়েছে।

 পরিবেশবান্ধব আবাসনের বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এ কারণেই নকশার সময় থেকেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।  প্রতিটি প্রকল্পে সোলারের মাধ্যমে বিকল্প আলোর ব্যবস্থা এবং রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতি রাখতে হবে। তাছাড়া আলো-বাতাসের পরিপূর্ণ ব্যবস্থা রাখতে সেটব্যাক মেনে পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা ছেড়ে তবেই ভবন নির্মাণ করতে হবে।’


প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব করেই সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপন সম্ভব। তাই প্রয়োজনের তাগিদে যত কংক্রিটের জঙ্গলই তৈরি হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত পরিবেশবান্ধব বিষয়টি নিশ্চিত না করা গেলে তা সুস্থ-সুন্দর জীবনের পরিপন্থী হয়ে উঠবে । এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।



বিজয় সরণির পাশে সবুজ গাছের সারির ভেতর দাঁড়িয়ে ছোট ভাইয়ের ছবি তুলছে আশিক। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের একটি জেলা শহর থেকে ঢাকায় বেড়াতে এসেছে ওরা। বিজয় সরণির সড়ক-সৌন্দর্য দেখে দু’জনেই মুগ্ধ। তিলোত্তমা নগরীর সড়ক-বিভাজকের সৌন্দর্য দেখে আশিকের মতো অনেকে মুগ্ধ হলেও আদতে সব ক্ষেত্রে কার্যকর হয়ে ওঠেনি এই ‘বিউটিফিকেশন’ প্রচেষ্টা।

নগরীতে সুস্থ জীবনমানের জন্য অন্তত ২৫ ভাগ সবুজ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু মহানগরীতে সবুজের উপস্থিতি মাত্র ১০ ভাগ। ঢাকায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আসরকে (যেমনÑ বিশ্বকাপ বা সার্ক সম্মেলন) সামনে রেখে ঘষে-মেজে আলোকসজ্জা আর সৌন্দর্যবর্ধক গাছ লাগিয়ে পরিপাটি করে তোলা হলে সড়ক-বিভাজক, সড়ক-দ্বীপ বা ফুটপাতগুলোর পাশে সারা বছরই থাকে বৃক্ষসজ্জা।



ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন বিপন কুমার সাহা জানান, ‘সড়ক-দ্বীপে গাছ লাগানোর বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ২০০৪ সালে প্রথমবারের মতো এই উদ্যোগের সঙ্গে দেশের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংযুক্ত করা হয়। সিটি করপোরেশন বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর এবং সর্বনিম্ন ৬ মাসের জন্য সড়ক-বিভাজক এবং ফুটপাতের পাশে গাছ লাগানোর জন্য চুক্তিবদ্ধ করে থাকে। তবে মূল পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানেই হয়।’


সৌন্দর্যবর্ধনের কাজে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের ওপর ডিসিসি-কর্তৃপক্ষ কতগুলো শর্ত জুড়ে দেয়। শর্তসাপেক্ষে ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান সড়কের কাঁচা অংশ, সড়ক-দ্বীপে ফুলগাছসহ ছায়াযুক্ত ও দৃষ্টিনন্দিত গাছ লাগানো, পরিচর্যা এবং সৌন্দর্যবর্ধনের লক্ষ্যে অনুমোদিত সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ঢাকা সিটি বিউটিফিকেশন সেল-কর্তৃক প্রদত্ত নকশা ও দিকনির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করার অনুমোদন দেয়া হয়। সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর বর্ণিত সড়কে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তাদের নামে বরাদ্দকৃত স্থানে বরাদ্দকৃত প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ তিনটি অনুমোদিত সৌন্দর্যবর্ধনমূলক বিজ্ঞাপনী সাইনবোর্ড/বিলবোর্ড স্থাপন করতে পারবে।

 তবে সাইনবোর্ডের আকার ও আকৃতি অবশ্যই ডিসিসি-কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। এছাড়াও ডিসিসি’র দেওয়া শর্তে বলা হয়েছে, সৌন্দর্যবর্ধিত এলাকা সঠিক পরিচর্যায় ব্যর্থ সংস্থাকে ডিসিসি প্রদত্ত অনুমোদনপত্র বাতিল করে অন্য আগ্রহী প্রতিষ্ঠানকে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হবে।


তবে সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর অনেক সড়কে গাছগুলোর নিয়মিত পরিচর্যা হয় না। আর পথচারীদের অত্যাচার তো আছেই। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিপন কুমার সাহা বলেন, ‘আমাদের তদারকিতে যখন আমরা দেখি কোনো স্থানের সৌন্দর্য ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না, তখন চুক্তি বাতিল করে অন্য প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘খালি থাকা সাপেক্ষে নতুন করে রক্ষণাবেক্ষণের কাজে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেওয়া হয়ে থাকে।’
তদারকির বিষয়ে লোকবল সঙ্কটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের লোকবলের মধ্যে সর্বোচ্চ তদারকি করা হয় যেন সৌন্দর্যবর্ধক কার্যক্রমের রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথ হয়।’


প্রকৃতিপ্রেমী-বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
সাহিত্যিক এবং প্রকৃতিপ্রেমী বিপ্রদাশ বড়–য়া বলেন, ‘অন্য সবকিছুর মতো আমাদের এই শহরে সড়ক-দ্বীপের গাছগুলোও অপরিকল্পিতভাবে লাগানো হয়েছে। এমনকি এই শহরের সড়ক-বিভাজকগুলোই পরিকল্পিত নয়। আগে রাস্তা তৈরি হয়েছে, পরে সড়ক-বিভাজক বানানো হয়েছে। এ কারণে অধিকাংশ সড়ক-দ্বীপ ছোট এবং আঁটসাঁট।’


একই ধরনের মতামত দেন নগর-বিশেষজ্ঞ স্থপতি মুশতাক কাদরী। তিনি বলেন, ‘ঢাকা একটি অগণতান্ত্রিক শহর। এখানে শহরের পরিকল্পনা হয় গাড়ি আর যানবাহন দিয়ে, মানুষ দিয়ে নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা শহর বৃক্ষ ধারণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, এখন যদি আমরা সত্যিই বৃক্ষ দিয়ে ঢাকা শহরকে সাজাতে চাই তাহলে অনেক দিকে মনোযোগ দিতে হবে।’
বিপ্রদাশ বড়–য়া বলেন, ‘বেশিরভাগ সড়ক-দ্বীপের ক্ষেত্রেই ছোট ছোট গর্ত করে গাছ লাগানো হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে লাগানো হচ্ছে বকুল, দেবদারু বা বড় বটগাছ। দৈনিক বাংলা থেকে ফকিরাপুল সড়কটিতে লাগানো হয়েছে দেবদারু গাছ। সিমেন্টের কারণে এসব গাছ নির্দিষ্ট গি র পরে আর বাড়তে পারছে না। তাছাড়া এত ঘন ঘন গাছ লাগানো হয় যে, এটা কেবলই বৃক্ষরোপণের অংশ হয়ে থাকে, কোনো কাজে আসে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘মতিঝিলে ১০ হাতের মধ্যে প্রায় ৫০টি বকুল-গাছ লাগানো হয়েছে। অথচ বাস্তবিক অর্থে কমপক্ষে দুটো বকুল-গাছের মধ্যে ২০ হাত দূরত্ব রাখা প্রয়োজন। আবার রাজউকের সামনের সড়কের পাশে পর্যাপ্ত মাটি আছে, কিন্তু সেখানে এত বেশি গাছ লাগানো হয়েছে যে, দেখলে এখন জঙ্গল মনে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে সংখ্যাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কত হাজার গাছ লাগানো হলো সেটাই যেন মুখ্য বিষয়। তবে আসলেই সবুজ চাইলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে নান্দনিক সৌন্দর্য বজায় রেখে এ ধরনের গাছ লাগানো উচিত।’


স্থপতি মুশতাক কাদরী বলেন, ‘সড়ক-দ্বীপে গাছ লাগানোর প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে সঠিক স্থানে সঠিক গাছটি লাগানো। দেখতে হবে, যে গাছটি আমরা লাগাতে চাই তার পরিবেশ আছে কিনা, যেখানে গাছ লাগানো হচ্ছে তার মাটির নিচে কী আছে, স্যুয়ারেজ বা গ্যাসের লাইন আছে কিনা, ওপরে বিদ্যুতের লাইনের কী অবস্থাÑ এ রকম নানা কিছু। ভুল গাছ লাগিয়ে যাতে কেটে ফেলতে না-হয় সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ একটি গাছ বড় হতে অনেক সময় লাগে।’


তিনি ঢাকা শহরে গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে একটি গাইডলাইন তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন। যেখানে কোথায় কোন গাছ লাগানো যাবে, সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য কোন ধরনের সড়ক-দ্বীপে কী ধরনের গাছ লাগানো যাবে, কোন গাছ লাগানো যাবে নাÑ এসব নির্দেশনা থাকবে। এখন নগরের সড়ক-দ্বীপের গাছগুলো পরিচর্যা করে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। সরকার যদি কোনো গাইডলাইন তৈরি করে দেয় তবে সেটি মেনেই গাছ লাগানোর কাজটি করতে হবে।

সমন্বয়ের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিপ্রদাশ বড়–য়া বলেন, ‘এসব গাছ লাগানোর জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা খুবই জরুরি।’ বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ভারতের রাজস্থানে দেখেছি ওদের সড়কের জন্য উপযোগী গাছ দিয়ে নান্দনিকভাবে সৌন্দর্য বাড়ানো হয়েছে। আমাদের উচিত এগুলো উদাহরণ হিসেবে নেওয়া।

বিশেষ করে গোলাপ, রক্তকরবী বা এ-ধরনের ছোট ছোট গাছ সড়ক-দ্বীপের জন্য খুবই ভালো। শুধু তা-ই নয়, দেশি তালগাছ এক্ষেত্রে আদর্শ হতে পারে। দেশি তালগাছ কেবল উপযোগীই নয়, বরং পাশাপাশি এটা থেকে ফলও পাওয়া যেতে পারে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।’

No comments:

Post a Comment